নীলদর্পণ নাটকে উচ্চশ্রেণীর চরিত্র-সৃষ্টিতে দীনবন্ধুর ব্যর্থতা
সাহিত্যস্রষ্টার প্রধান গুণ হ'ল, সৃষ্টিকৌশল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন যে, কবি ঈশ্বর গুপ্তের এই ক্ষমতা ছিল না, তবে দীনবন্ধু মিত্রের মধ্যে এই সক্ষমতা ছিল বহুল পরিমাণে। তবে নাট্যকার দীনবন্ধু তাঁর শিল্পোৎকর্ষের পরিচয় ভদ্রেতর চরিত্রদের ক্ষেত্রে দেখালেও যা সূক্ষ্ম, কোমল, মধুর, অকৃত্রিম, করুণ ও প্রশান্ত—সে সব ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারেননি। তাঁর লেখনীতে অসঙ্গত, বিসদৃশ বিষয় ও ভদ্রেতর চরিত্রসমূহ বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে উঠলেও বিনায়ক, ললিতমোহন, নবীনমাধব, লীলাবতী, মালতী, সৈরিন্ধ্রী প্রমুখ ভদ্রচরিত্রসমূহ বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে ওঠেনি। যদিও বাংলার সমাজ বিষয়ে নাট্যকারের বহুদর্শিতা ছিল অত্যন্ত প্রগাঢ়। দীনবন্ধুর আবাল্য সুহৃদ বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করেছিলেন,
“সকল শ্রেণীর বাঙালীর দৈনিক জীবনের সকল খবর রাখে এমন বাঙ্গালী লেখক আর নাই।”
দীনবন্ধু সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে পারতেন এবং রাজকর্মে জড়িত থাকার সূত্রে তাঁর সেই সুযোগও এসেছিল; ফলে তিনি তাঁর নাটকে জীবিত আদর্শ সামনে প্রতিস্থাপন করে চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আর তাঁর এই লোকজ্ঞতার সঙ্গেই সাযুজ্যকৃত হয়েছিল প্রবল ও স্বাভাবিক সর্বব্যাপী সহানুভূতি। এই গুণ-হেতু তিনি সর্বশ্রেণীর চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু যেখানেই তাঁর এই গুণ দু'টির অভাব ঘটেছে, সেখানেই সৃষ্টি হয়েছে ব্যর্থ।
'নীলদর্পণ' বা অন্য নাটকে উচ্চশ্রেণীর চরিত্র সৃষ্টিতে দীনবন্ধুর পারদর্শিতার কারণ নিরূপণ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র নাট্যকারের অভিজ্ঞতার অভাবের কথা বলেছেন। অভিজ্ঞতার অভাবে তাঁর সর্বব্যাপিণী সহানুভূতি কার্যকরী হয়নি। জীবন্ত আদর্শকে আশ্রয় করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ঘটে, এর অভাবে নাট্যকারের তথ্য সাহিত্যস্রষ্টার সহানুভূতি প্রদর্শন সম্ভব হয়না ।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দীনবন্ধুর স্বীয় শ্রেণী সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল না, এ কথা মানা যায় না। অথচ, কার্যক্ষেত্রে এই শ্রেণীর চরিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে তিনি তাদেরকে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রোমান্সের রাজ্যে স্থাপন করেছেন। বসু পরিবারের একমাত্র নবীনমাধব-ই অতিমাত্রায়ই আদর্শবাদী নন, নটের সকল ভদ্রশ্রেণীর নারী-পুরুষই আদর্শলোকের বাসিন্দা। বঙ্কিম এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, দীনবন্ধু মিত্র ইংরাজী ও সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করে সেই ছাঁচে তাঁর নায়ক-নায়িকাদের ঢালতে চেয়েছিলেন। জীবন্ত আদর্শ তাঁর সামনে না থাকায় বাস্তব চিত্র ফোটাতে পারেননি। তাঁর নায়ক চরিত্রেরা আদর্শবাদী কিংবা প্রেমিক। আসলে তিনি চরিত্র সৃজনকালে গ্রন্থাদর্শ গ্রহণ করায় তাঁর সৃষ্ট উচ্চশ্রেণীর চরিত্রাবলী স্বাভাবিক ও যথার্থ হয়নি।
নীলদর্পণ নাটকে উচ্চশ্রেণীর চরিত্র সৃষ্টিতে নাট্যকারের অসাফল্যের দু'টি কারণ হ'ল,
এক, তিনি ভদ্রেতর চরিত্র-সৃষ্টিকালে বাস্তব জীবনাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন ; ভগ্ন, স্থূল ও অতি-প্রত্যক্ষ জীবন থেকে জীবনরস আহরণ করেছিলেন, চেনা-জানা সংসার থেকে সাধারণ মানুষদের চয়ন করে তাদের রূপবিশিষ্ট করে তুলেছিলেন। অথচ উচ্চশ্রেণীর চরিত্র অঙ্কনকালে সমকালীন রোমান্সের প্রভাবাধীন হয়েছিলেন। ফলে এইসকল চরিত্রেরা হয়ে উঠেছে সর্বগুণান্বিত। রোমান্সলোকের চরিত্রেরা আবর্তিত হয়ে থাকে কোন বিশেষ মানসিক বৃত্তিকে কেন্দ্র করে (তবে, অতি উচ্চ কবি-কল্পনার অধিকারী হওয়ায় বঙ্কিমের চরিত্রসমূহ উপন্যাসে সৃষ্ট বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করায় তাদেরকে আর অবাস্তব মনে হয়না)। দীনবন্ধু মিত্র বাস্তব-জীবনের মধ্যে আদর্শ আরোপ করায় তা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। যেহেতু নাটক দৃশ্যকাব্য, সেহেতু এক্ষেত্রে সকল ঘটনা ও মানসক্রিয়াকে প্রত্যক্ষগোচর করাতে হয়, এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা ও বর্ণনার কোনো অবকাশ নেই। নবীনমাধব, বিন্দুমাধব, মাতা সাবিত্রী ও দুই বধূর আচরণ-ভাব-ভাবনা আদর্শ জগতে উন্নীত হয়েছে, বাস্তব জীবনপ্রবাহের সঙ্গে বৈপরীত্যের কারণে অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে।
দুই, সেই সঙ্গে এইসব উচ্চশ্রেণীর মুখে কৃত্রিম ভাষা ব্যবহার সঙ্গতির অভাব সৃষ্টি করেছে। এদের কণ্ঠে নাট্যকার যে-ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা যেমন প্রাণজ নয়, তেমন শিষ্ট সাহিত্যেরও নয়।
নাট্য-ভাষার দু'টি ধর্ম হ'ল,
(ক) এ'টি ভাব-প্রকাশের উপায় এবং
(খ) নাটকের গতিদানের সহায়ক।
কিন্তু নীলদর্পণের ভাষার গতিমানতার অভাবে এই ধর্ম রক্ষিত হয়নি।
বস্তুতপক্ষে উচ্চশ্রেণীর চরিত্রসমূহের চিত্র ভাব ও ভাষার অতিরেকের কারণে অস্বাভাবিক হয়েছে। বাস্তব চরিত্রাঙ্কনে নাট্যকার সাফল্য দেখালেও যেখানে বাস্তব ও রোমান্সের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ব্যাহত হয়েছে রসসৃষ্টি।
